রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মুসলিম জাতির জীবনে রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। মুসলিম উম্মাহর জন্য ফরজ ইবাদাত গুলোর মধ্যে রমজান মাসের রোজা বা সিয়াম একটি অন্যতম ফরয ইবাদাত। রোজা বা সিয়ামের প্রতিদান আল্লাহ তার বান্দাদের নিজের হাতে দিবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্যের

এ মাসে সকল মুসলিম নারী ও পুরুষ সুভহে সাদেক হতে সুর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার ও অশ্লীল কাজ হতে বিরত থাকে। রমজান মাসে আল্লাহ তাআলা শয়তানদের শিকল দিয়ে বেধে রাখেন ,যার ফলে এ মাসে আমরা শয়তানের কুমন্ত্রনা থেকে রেহায় পেয়ে থাকি।

ভুমিকা

আভিধানিক অর্থে বিরত থাকাকে সওম বা রোজা বলে ,যার বহুবচন হচ্ছে সিয়াম। শরিয়তের পরিভাষায় সওম বা রোজা একটি ইবাদাতের নাম। যাতে মুসলমান নারী-পুরুষ সুভহে সাদেক হতে আরম্ভ করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌন সম্ভোগ হতে বিরত থাকে। বছরে একটি নির্দিষ্ট মাস রমজানে এই সওম পালন করা প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরয। নারী, পীড়িত ও মুসাফিরের জন্য শিথিলতার কিছু বিধান রয়েছে।

রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

রমজান মাসে রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্য এত বেশি যে তা বলে শেষ করা যাবে না। মহান আল্লাহ বলেন "হে মুমিনগণ তোমাদের জন্য রোজা ফরয করা হল, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তিদের উপর, যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পার।"(সুরা বাকারাঃ ১৩৮)
যে বছর রমজানের রোজা ফরয হয় সে বছর রোজার মাসটি ছিল অত্যান্ত গরম। এ জন্য সম্ভবতঃ একে রমজান নামে অভিহিত করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন ,এ মাসের রোজার বিনিময়ে রোজা পালনকারীর পাপরাশি ভষ্মিভুত হয়ে যায় বলে রোজার মাসকে রমজান মাস বলা হয়। রোজার ফরয পবিত্র কোরআন দ্বারা প্রমানিত হয়েছে।
ইমাম বুখারী (রা) এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের আয়াত উল্লেখ করেছেন। এটা সর্বসম্মত যে, রমজানের রোজা অশ্বিকারকারী কাফের।
সাহল (রা) হতে বর্ণিত ,নবী (স) বলেন, জান্নাতে রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন রোজাদাররাই প্রবেশ করবে। তাদের ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষনা দেওয়া হবে, রোজাদাররা কথায়? তখন তারা দাড়াবে।তারা ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে।যাতে করে এ দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে।

রোজার ফজিলত সম্পর্কে হাদিস

আরবি মাসের মধ্যে সবথেকে ফজিলতপূর্ণ মাস হল রমজান। এ মাসে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন মাজীদ নাযিল করেছেন। এবং সেই সাথে রমজান মাসের ৩০ রোজাকেও আল্লাহ তায়ালা মুসলিম জাতির জন্য ফরজ করে দিয়েছেন। রোজার প্রতিদান আল্লাহ তা'আলা স্বয়ং নিজের হাতে দিবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন। রোজার ফজিলত সম্পর্কে অসংখ্য হাদিস রয়েছে, যার কয়েকটা নিচে তুলে ধরা হলোঃ
আয়েশা (রা) নবী (স) হতে বর্ণনা করেছেন, কিয়ামতের দিন নিয়ত অনুযায়ী লোকদের উঠানো হবে।
আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদরের রাত্রি জেগে ইবাদত করবে তার পেছনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। আর যে রমজান মাসে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রোজা রাখবে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) হতে বর্ণিত,রাসুলুল্লাহ (স) বলেন,কোরআন এবং রোজা কিয়ামতের দিন প্রত্যেকটি বান্দার জন্য সুপারিশ করবে।কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন।
রোজা বলবে হে আমার প্রতিপালক আমি তাকে পানাহার ও অশ্লীল কাজ কর্ম থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন । নবী করিম (স) বলেছেন, সুতরাং কুরআন এবং রোজা উভয়েরই সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।

ইসলামে রোজার গুরুত্ব

মহান আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে মুসলমানদের জন্য রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন ।মুসলমানেরা রোজার উপকারিতা এবং এর উদ্দেশ্য অনেকভাবেই বোঝে। এক আল্লাহকে বিশ্বাস এবং তাকওয়াকে শক্তিশালী করতে রোজা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রোজা মানুষকে আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং সংযম শেখায়।
মানুষের পাপের ক্ষমা চাওয়ার জন্য এবং মহান আল্লাহ তালাকে খুশি করার একটি অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে রোজা। মহান আল্লাহ তা'আলা বলেন ;রোজা আমারই জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব ।এছাড়া রোজা গরিব অসহায় দুর্দশা গ্রস্ত মানুষের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় ।

রোজার উপকারিতা কি কি

রোজা একটি ধর্মীয় ইবাদাত তাই রোজা রাখার ফলে যেমন মানসিক প্রশান্তি অনুভূত হয় তেমনি এর শারীরিক উপকারিতা ও অনেক । রোজা রাখার ফলে স্ট্রেস হরমোনের নিঃসরণ কমে যায় যার ফলে ব্রেনের কর্মক্ষমতা অনেক বেড়ে যায় । রোজা মানুষের বার্ধক্য কমাতে পারে । এছাড়াও ডায়াবেটিস ,থাইরয়েড রোগ,উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের বিকাশ কমায়। এটি মানুষের ওজন কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া মানুষ দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার অভ্যাস করলে সঠিক পথে চলার শক্তি পাই ।

রোজাদারদের জন্য জান্নাতের দরজা

সাহল রাজিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত ,নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,জান্নাতে রাইয়ান নামক দরজা রয়েছে । এই দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন শুধুমাত্র রোজাদাররাই প্রবেশ করবে । ঘোষণা করা হবে রোজাদাররা কোথায় ? তখন রোজাদাররা দাঁড়াবে এবং তারা এই দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশের পর দরজাটি বন্ধ করে দেয়া হবে । এই দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না ।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত ;রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ;যে নামাজ আদায় করবে, তাকে নামাজের দরজা দিয়ে ডাকা হবে । যে মুজাহিদ,তাকে জিহাদের দরজা দিয়ে ডাকা হবে । যে রোজাদার ,তাকে রাইয়ান দরজা হতে ডাকা হবে ।যে সাদকা দানকারী ,তাকে সাদকার দরজা দিয়ে ডাকা হবে।
অতঃপর আবু বকর (রাঃ) বলেন ,হে আল্লাহর রাসুল (সঃ) আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা কুরবান হোক ,সকল দরজা দিয়ে কাউকে ডাকার প্রয়োজন নেই,তবে সব দরজা দিয়ে কি কাউকে ডাকা হবে ? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ,হ্যাঁ আমি আশা করি তুমি তাদের মধ্যে হবে ।(বুখারী )

রোজাদারদের জন্য দুইটি আনন্দ

রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্যের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল সাহারি খাওয়া এবং সঠিক সময় ইফতার করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা সাহারি খাও, কেননা সাহারিতে বরকত রয়েছে । মহান আল্লাহ তাআলা সূরা বাকারার ১৮৭ নং আয়াতে বলেন ,”আর তোমরা পানাহার করো যতক্ষণ না কালোরেখা থেকে ভোরের সাদা রেখা পরিষ্কার দেখা যায় ।তারপর রোজা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত “।
এ বিষয়ে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম হতে বারা রাজিআল্লাহু তা'আলা আনহু হাদিস বর্ণনা করেছেন । আদি বিন হাতিম রাজারাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত,তিনি বলেন,যখন এই আয়াত নাযিল হলো - ”তোমরা পানাহার করো রাতের কালো রেখা হতে ভোরের সাদা রেখা, যতক্ষণ স্পষ্ট রূপে তোমাদের কাছে প্রতিভাত না হয়” তখন আমি একটি কালো এবং একটি সাদা রশি নিলাম এবং উভয়টিকে আমার বালিশের নিচে রেখে দিলাম।
রাতে আমি এগুলোর দিকে বারবার তাকাতে থাকি ; কিন্তু আমার কাছে পার্থক্য প্রকাশিত হলো না । তাই সকালেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে গিয়ে এ বিষয়ে বললাম ।তিনি বললেন ,এতো রাতের অন্ধকার এবং ভোরের আলো । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বক্তব্যে আদি বিন হাতেম রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আসল ব্যাপারটি অবহিত হলেন যে, সাদা এবং কালো রেখা বলতে আসলে সুবহে সাদেক সুবহে কাযেবকে বোঝানো হয়েছে ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ,যতদিন মানুষ সঠিক সময়ে ইফতার করবে ততদিন তারা কল্যাণের সাথে থাকবে । ”ইফতারের সময় দোয়া কবুল হওয়ার ব্যাপারে বর্ণিত হাদিস শুদ্ধ নয় । কেননা রোজা কারীর দোয়া সবসময় কবুল হয় । অনুরূপভাবে ইফতারের সময় “আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়ালা রিযকিকা আফতারতু” দোয়ার হাদিসও দঈফ। ইফতার শেষে পঠনীয় দোয়া “ যাহাবায যামাউ অবতাল্লাতিল উরুকু অসাবাতাল আজ্রু ইনশাআল্লাহ।

তারাবির নামাজ

রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্যের মধ্যে অন্যতম আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো তারাবির নামাজ । আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত ,তিনি বলেন,আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে রমজান সম্পর্কে বলতে শুনেছি,যে ব্যাক্তি রমজানে ঈমানের সাথে সব লাভের আশায় কিয়ামে রমজান অর্থাৎ তারাবির নামাজ আদায় করবে তার পূর্ববর্তী গুনাহ সমূহ মাফ করে দেয়া হবে ।

লাইলাতুল কদরের ফজিলত

মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা আল কদর এর ১-৫নং আয়াতে বলেন,” আমি নাযিল করেছি এই কুরআন মহিমান্বিত রাতে । আর আপনি কি জানেন মহিমান্বিত রাত কি ?মহিমান্বিত রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম । সেই রাতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতাগণ এবং রূহ তাদের প্রতিপালকের আদেশে অবতীর্ণ হয় । সেই রাতে শান্তিই শান্তি ফজর হওয়া পর্যন্ত ।
”আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত ,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান করো ।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত ,তিনি বলেন,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইতিকফ করতেন এবং বলতেন ,তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর ।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত ,তিনি বলেন,যখন রমজানের শেষ দশক আসতো তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার লুঙ্গি কষে নিতেন (বেশি বেশি ইবাদাতের প্রস্তুতি নিতেন )এবং রাত জেগে থাকতেন ও পরিবার পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন ।
নবীর সহধর্মিনী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত যে, নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন । তার ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল । এরপর তার স্ত্রী টাও এই দিনগুলোতে ইতিকাফ করতেন ।

লেখকের মন্তব্য

উপরিক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম রমজান মাসে রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্য মুমিন মুসলমানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । তাই মুসলিম হিসেবে আমাদের উচিত রমজান মাসকে গুরুত্ব দিয়ে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করা এবং সিয়াম ও কিয়াম এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।
এতক্ষণ ধৈর্য সহকারে আপনার মূল্যবান সময় দিয়ে আমাদের পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ । এরকম তথ্যবহুল বা আপনার কাছে ভালোলাগা পোষ্ট পেতে আমাদের ওয়েবসাইটটি ভিজিট করুন, কমেন্ট বক্সে আপনার মতামত দিন এবং শেয়ারের মাধ্যমে অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url