শবে কদরের আলামত সমূহ এবং শবে কদরের তাৎপর্য বিস্তারিত জানুন
লাইলাতুল কদর বা শবে কদর হল হাজার বছরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রাত। শবে কদরের আলামত সমূহ, শবে কদরের তাৎপর্য এবং শবে কদরে করণীয় সম্পর্কে আমরা আজকের এই আর্টিকেল টি থেকে জানবো ইনশাআল্লাহ। লাইলাতুল কদর বা শবে কদরের রাত নির্দিষ্ট করে দেখানো হয়নি তবে শবে কদরের রাতের কিছু আলামত আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন।
শবে কদরের রাত যদি নির্দিষ্ট থাকত তাহলে অন্যান্য দিনে মানুষ ইবাদত করা থেকে গাফেল হয়ে যেত যা শরীয়ত সম্মত নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন," আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছে এবং আমাকে তা ভুলিয়েও দেয়া হয়েছে। অতএব তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজর রাত্রিতে তা তালাশ কর"।
ভূমিকা
পবিত্র কুরআনে লাইলাতুল কদরের রাত বা শবে কদরের রাতকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ রাত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রত্যেক মুসলমানের কাছে এ রাত টি অত্যন্ত প্রিয় এবং আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার একটি মাধ্যম ও বটে। শবে কদরের রাত কোনটি পবিত্র কোরআনে তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। তবে শবে কদরের আলামত পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে।
শবে কদরের আলামত সমূহ
পবিত্র হাদিস গ্রন্থে শবে কদরের আলামত সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। শবে কদরের আলামত সমূহ নিচে দেওয়া হলঃ
আরো পড়ুনঃযাকাত দানের ফজিলত
১) শবে কদরের রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না। অর্থাৎ এ রাতটি একবারে ঘন কালো অন্ধকার হবে না।
২) এই রাতে খুব বেশি গরম বা খুব বেশি ঠান্ডা হবে না। অর্থাৎ রাতটি নাতিশীতোষ্ণ হবে।
৩) এই রাতে রহমতের মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হবে।
৪) এই রাতে সামান্য পরিমাণে হলেও বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে।
৫) শবে কদরের সকালে হালকা আলোকরশ্মি সহ সূর্যোদয় হবে। এই দিনে সূর্যের আলোটা প্রখর হবে না। যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মত।
৬) শবে কদরের রাত্রিতে মানুষ অন্যান্য দিন বা রাতের চেয়ে আল্লাহর ইবাদত করে অপেক্ষাকৃত তৃপ্তি লাভ করবে।
৭) কোন ঈমানদার মুমিন ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা এই রাতের কথা স্বপ্নে জানিইয়েও দিতে পারেন।
শবে কদরে করণীয়
শবে কদরের রাত কবে সেটা মহান আল্লাহ তায়ালার পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট করে উল্লেখ করে দেননি। তবে শবে কদরের আলামত সমূহ মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন এবং শবে কদরের ফজিলত সম্পর্কেও মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন। শবে কদরে করণীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলোঃ
পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতঃ শবে কদরের এই রাত্রিতে পবিত্র কোরান মহান আল্লাহ তায়ালা নাযিল করেন। আর এই কুরআনের বরকতের জন্যই এই রাতটিও বরকতমতি। তাই শবে কদরের রাত্রিতে আল্লাহ তালাকে সন্তুষ্ট করার জন্য মুমিনদের উচিত বেশি বেশি কোরআন তেলোয়াত করা। এছাড়াও কুরআনের অর্থ এবং তাফসিরগুলো বুঝে বুঝে পড়া।
দোয়া ও প্রার্থনা করাঃ শবে কদরের রাত পাপী বান্দাদের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা চাওয়ার একটি উত্তম সময়। কেননা এই রাত্রিতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ তা'আলা তার সকল পাপ মাফ করে দেন। এছাড়াও মানুষের জীবনে সকল চাওয়া এবং আবদার এই রাত্রিতে আল্লাহর কাছে বললে আল্লাহ তা'আলা তা পুরন করে দিবেন ইনশাআল্লাহ।
দান করাঃ জান্নাত লাভ করার একটা উত্তম উপায় হলো দান। দান করার মাধ্যমে মানুষ জান্নাত মহান আল্লাহ তা'আলার কাছ থেকে কিনতে পারেন। বছরের যে কোন সময় দান করা যায়। তবে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসের শুরু থেকেই প্রচুর পরিমাণে দান করতেন।
কেননা রমজান মাসে যে কোন পণ্য কাজের সওয়াব অন্য মাসের তুলনায় অনেক বেশি। আর শবে কদরের রাত হল সকল রাতের চেয়ে উত্তম রাত। তাই এই রাত্রিতে বেশি বেশি দান করলে অন্য সকল সময়ের চেয়ে মহান আল্লাহর দরবারে এর গ্রহণযোগ্যতা বেশি হবে। দান হিসেবে আমরা অর্থ বা খাবার যে কোনটা দিতে পারি।
ইতিকাফ করাঃ রমজান মাসের শেষের ১০ দিন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতেকাফ করতেন। ২০ রমজানের সূর্যাস্তের আগ মুহূর্ত থেকে ঈদের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত এতেকাফ করা আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত।
এতেকাফ করা অবস্থায় দুনিয়াবী সমস্ত কাজকর্ম বাদ দিয়ে শুধুমাত্র মহান আল্লাহ তাআলার ইবাদতে মশগুল থাকতে হয়। এর মাধ্যমে আল্লাহকে সব সময় স্মরণ করার প্রশিক্ষণ এবং আত্মশুদ্ধি লাভ করা যায়।
ফরজ সালাতের পাশাপাশি সুন্নাত ও নফল সালাত আদায় করাঃ আমরা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে থাকি। রমজান মাসে এই ফরজ সালাত অন্যান্য সময়ের ৭০ টি ফরজের সমতুল্য। রমজান মাসে নফল সালাত আদায় করলে অন্যান্য সময়ের ফরজ আদায়ের সমান সব পাওয়া যায়। এক কথায় রমজান মাস হল ফরজ সুন্নাত এবং নফল সালাতের সেরা সময়।
আর হাজার রাত অপেক্ষায় উত্তম লাইলাতুল কদরের রাত ফরয সুন্নত এবং নফল সালাত আদায়ের অন্যতম সময়।
শবে কদরের তাৎপর্য
শবে কদরের আলামত সমূহ দেখলেই আমরা শবে কদরের রাত্রি চিনতে পারব। শবে কদরের রাতের অনেক তাৎপর্য রয়েছে। একজন খাঁটি মমিন মুসলমানের জন্য শবে কদরের তাৎপর্য জেনে ঈমান আমলের সাথে এই রাত্রিটিতে মহান আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করা প্রয়োজন। এতে তার ঈমান বৃদ্ধি পাবে এবং সে ইবাদতেও শান্তি পাবে।
মক্কার জাবালে নূর পর্বতের সেরা গুহায় আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হযরত জিব্রাইল আলাই সাল্লাম এর মাধ্যমে আল্লাহর বাণী পবিত্র কুরআনের ৫ আয়াত নাযিল হয়েছিল শবে কদরের এই রাত্রিতে। এটি ছিল কুরআনের ৯৬ তম সূরা আল আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত।
এরপর থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দীর্ঘ 23 বছর ধরে কোরআন নাজিল হয়েছে। পবিত্র কুরআন মাজীদে লাইলাতুল কদরের ফজিলত সম্পর্কে একটি পূর্ণ সূরা নাযিল হয়েছে। শবে কদরের রাত্রি হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এই রাত্রিতে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে ফেরেশতারা পৃথিবীতে নেমে আসে এবং ভোর হওয়া পর্যন্ত পৃথিবীতে শান্তি বর্ষণ করে থাকেন।
লাইলাতুল কদরের রাত্রিতে একটি নেক আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হলে তা হাজার মাসের বরকত নিয়ে আসে। এছাড়া এই রাত্রি আল্লাহর রহমতে এবং ক্ষমা পাওয়ার একটি উত্তম সময়। লাইলাতুল কদরের রাতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তার নৈকট্য লাভের জন্য মুমিনদের একটি চরম সুযোগ করে দিয়েছেন।
লাইলাতুল কদরের রাত্রিতে কোন মোমেন বান্দা যদি ঈমানের সাথে সালাত আদায় করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় তাহলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসের শেষ দশকের বেজোর রাত্রিতে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করতে বলেছেন।
শবে কদরে বর্জনীয়
শবে কদরের আলামত সমূহ দেখে আমরা শবে কদরের রাত চিহ্নিত করতে পারি। এই রাতকে প্রাধান্য দিতে যে অনেকেই এমন কিছু কার্যকলাপ করে থাকেন যা বর্জনীয়। শবে কদরে বর্জনীয় দিকগুলো নিচে তুলে ধরা হলোঃ
অধিক বিশ্রাম পরিত্যাগ করাঃ অতি পবিত্র ও সওয়াব হাসিলের সবথেকে উত্তম ও তাৎপর্যপূর্ণ রাত হল লাইলাতুল কদর। সেজন্য এ রাতে অতি সামান্য পরিমাণ ঘুম ও বিশ্রাম করে বাকি সময়টা ইবাদতের জন্য কাটিয়ে দেওয়া একজন ঈমানদার বা মুমিন ব্যক্তির উত্তম কাজ হবে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,' ঈমান এবং সওয়াব লাভের আশায় আল্লাহর দরবারে লাইলাতুল কদরের যে ব্যক্তি ইবাদত করার জন্য দাঁড়াবে, তার পিছনের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে'।
অতিরিক্ত ভোজ-আয়োজন ত্যাগ করাঃ আমরা জানি ইবাদতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার মানে হলো শরীর ও মনকে ফ্রেশ বা হালকা রাখা কিন্তু আমরা অনেকেই তা না করে এই দিনটাতে অনেক কিছু খাবারের আয়োজন করে থাকি এবং তা ভক্ষণের জন্য অনেক সময় ব্যয় করে থাকি। এতে করে আমাদের শবে কদরের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়ে থাকে।
তাই আমাদের এই রাতটিকে সঠিকভাবে পালনের জন্য অযথা খাবার আয়োজনে এবং ভক্ষণে সময় ব্যয় না করে এই সময়টাকে কাজে লাগানো। কারণ এই গুরুত্বপূর্ণ রাত্রি আরেকবার আমাদের জীবনে আসবে, ক্ষমা চাইতে পারব, ইবাদত করতে পারব, চোখের পানি ফেলে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করতে পারব তার কোন গ্যারান্টি নাই।
বিদআত বর্জন করাঃ ইসলাম একটি বিজ্ঞানভিত্তিক জীবন বিধান। কুরআন সুন্নাহর বাহিরে অতিরিক্ত কাজ করাকে বিদআত বলা হয়। তাই আমাদের উচিত লায়লাতুল কদর রাতে সকল প্রকার বিদআত মূলক কার্যক্রম হতে বিরত থেকে ইবাদত বন্দেগী করে নিজেকে আল্লাহর নিকট অর্পণ করা।
শবে কদরের রাতে কি কি দোয়া পড়তে হয়
শবে কদরের রাতে কি কি দোয়া পড়তে হয় এমন প্রশ্ন অনেকের মনেই হতে পারে। শবে কদরের রাত হলো মানুষের যত আবদার যত চাওয়া সবকিছু মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে নিবেদন করার রাত। এই রাতে বিভিন্ন দোয়া করা যায়।
এর মধ্যে পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার দোয়া, পিতা-মাতার জন্য দোয়া, ঋণ মুক্তির দোয়া, শিরক থেকে মুক্ত থাকার দোয়া, হিংসা বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকার দোয়া, রোগমুক্তির দোয়া, পৃথিবীর সমস্ত মুমিন মুসলমানের জন্য দোয়া, আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের দোয়া, আল্লাহর জিকির আজগারে ব্যস্ত থাকার দোয়া এছাড়াও আরো অনেক দোয়া করা যায়।
তবে লাইলাতুল কদরের সর্বোত্তম এবং ফজিলতপূর্ণ দোয়া হলো" আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা'ফু আন্নী"। এই দুয়ার অর্থ হল- 'হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করাটা আপনার পছন্দ। অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন'।
লেখক এর মন্তব্য
উপরের আলোচনা থেকে আমরা শবে কদরের আলামত সমূহ এবং শবে কদরের রাত্রিতে করণীয় বর্জনীয় আমলগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছি। শবে কদরের রাত মুসলমানদের জন্য অনেক আকাঙ্ক্ষিত একটি রাত। সকল মুমিনদের উচিত শবে কদরের রাত্রিতে মহান আল্লাহ তাআলার ইবাদত করে তার সন্তুষ্টি লাভ করা।
আশা করি আমাদের আর্টিকেল থেকে শবে কদরের আলামত এবং শবে কদরের তাৎপর্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। এতক্ষণ আমাদের আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ার জন্য আপনাকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ। এরকম তথ্যপূর্ণ আরো পোস্ট পেতে আমাদের ওয়েবসাইটটি ভিজিট করুন এবং শেয়ারের মাধ্যমে আপনার পরিচিতদের পড়ার সুযোগ করে দিন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url