লাউ শাকের উপকারিতা ও অপকারিতা
লাউ শাক ঘরের চালে,উঠানে,খেতে খামারে এবং বাড়ির আশেপাশে অনেক জায়গাতেই জন্মাতে দেখা যায়। লাউ শাক আমাদের দেশের অনেক জনপ্রিয় একটি শাক। লাউ শাকের উপকারিতা এবং পুষ্টিগুণ অনেক। লাউ শাক পছন্দ করে না এমন লোক খুঁজে বের করা মুশকিল। লাউ শাক দেখতে সাদাসিধে এবং সহজলভ্য হওয়ায় মানুষের কাছে এটি অতি প্রিয়।
লাউ শাক সারা বছরই পাওয়া যায়। লাউ গাছ যে কোন জায়গাতেই লাগানো হোক না কেন তা খুব তাড়াতাড়ি তর তর করে বেড়ে ওঠে। লাউ শাক সারা বছরই পাওয়া যায় তবে শীত মৌসুমে এর ফলন ভালো হয়। মৌসুমে শুধু লাউশাকের ফলন ভালই নয় বরং লাউ শাকের স্বাদ বেড়ে যায় অনেক গুণ বেশি।
ভূমিকা
লাউ শাক ভর্তা, ঝোল, লাউ শাক ভাজি এবং মাছের সঙ্গে খাওয়া যায়। লাউশাকে রয়েছে ফলিক এসিড, আয়রন,পটাশিইয়াম, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি ইত্যাদি। এছাড়াও লাউশাক এ রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আঁশ। লাউ শাক শরীর-স্বাস্থ্য সুস্থ এবং ভালো রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লাউ শাকের উপকারিতা অনেক। আজকে আমরা লাউ শাকের উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
লাউ শাকের উপকারিতা
মানুষের শরীরের পুষ্টির চাহিদা পূরণে লাউশাকের গুরুত্ব অপরিসীম। নিচে লাউ শাকের উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
১) লাউশাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন। আয়রন থাকার কারণে লাউ শাক রক্তের হিমোগ্লোবিনের সংখ্যা বাড়াতে এবং লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা বাড়িয়ে রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে।
২) লালসাগে রয়েছে উচ্চ মাত্রার ভিটামিন সি। যা বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ ও ঠান্ডা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
৩) লাউশাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আশ। ফলে এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে এবং পাইলস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪) লাউ শাক বিটা ক্যারোটিন, লুটেইন এবংজিয়েজ্যান্থিনে পরিপূর্ণ। বিটা ক্যারোটিন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং লুটেইন ও জিয়েজ্যান্থিন চোখের নানা বিদ রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। ৫) লাউ শাক দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। তাই লাউ শাক খেলে মস্তিষ্ক ঠান্ডা থাকে এবং রাতে ঘুম ভালো হয়।
৬) লাউ শাকে রয়েছে ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম যা শরীরের হাড় শক্ত এবং মজবুত করতে সাহায্য করে। অস্ট্রিওপোরেসিস এবং অন্যান্য ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত রোগের ঝুঁকি কমায় এই লাউ শাক। ৭) লাউশাক কোলেস্টেরল এবং ফ্যাট মুক্ত। লাউ শাকে ক্যালরি কম থাকায় ওজন কমাতে সাহায্য করে। লাউশাকে থাকা পটাশিয়াম হৃদ স্পন্দন এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে।
গর্ভাবস্থায় লাউ শাক খাওয়ার উপকারিতা
গর্ভাবস্থায় লাউ শাক খাওয়ার উপকারিতা অনেকেই জানে না। অনেকেই চিন্তা করে গর্ভাবস্থায় লাউ শাক খেলে কি উপকার হয় নাকি ক্ষতি হয়। মহিলা পুরুষ উভয়েরই লাউ শাক খাওয়ার উপকারিতা অনেক। লাউ শাকে প্রচুর পুষ্টিকরণ থাকায় গর্ভাবস্থায় লাউ শাক খাওয়ার উপকারিতা ও রয়েছে।
লাউ শাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফলিক এসিড। ফলিক এসিড সমৃদ্ধ খাবার বেশ উপকারী গর্ভে থাকা শিশুর জন্য। কেননা শিশুর স্পাইনাল কর্ড এবং মস্তিষ্কের বৃদ্ধির জন্য ফলিক এসিড খুবই কার্যকরী। গর্ভবতী মায়ের খাদ্যে ফলিক এসিডের অভাব হলে মায়ের পেটে থাকা শিশুর স্পাইনাল কর্ডের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এমনকি প্যারালাইসিস পর্যন্ত হতে পারে।
এমনকি মস্তিষ্কের বিকৃতি দেখা দিতে পারে। এছাড়াও মায়ের পেটের মধ্যে শিশু মৃত্যু হতে পারে। তাই আমাদের সবার উচিত গর্ভাবস্থায় মায়ের খাবারের দিকে খেয়াল রাখা যেন খাবারের তালিকায় ফলিক এসিড সমৃদ্ধ খাবার থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রয়োজনে চাইলে আপনি অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারেন।
লাউ শাক খাওয়ার নিয়ম
নির্বাচন ও সংরক্ষণঃ নির্বাচন করার সময় স্বার্থপর ও পাকা লাউ নির্বাচন করুন। লাউ বিশেষভাবে পরিষ্কার করে রাখতে হবে এবং ঠান্ডা স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে।
প্রস্তুতিঃ লাউ সাজের খোসা গুলি সংরক্ষণ করুন এবং অপরিষ্কার অংশগুলো ছেদ করুন । এরপর লাউ শাককে ভালোভাবে পানি দিয়ে পরিষ্কার করুন এবং প্রয়োজনমতো লাউ শাককে ছেদ করে টুকরা করুন।
রান্নাঃ লাল শাককে ভালোভাবে ধুয়ে নেওয়ার পর এটিকের স্লাইজ বা কিউব করে কেটে নিন। এরপর ১০ থেকে ১৫ মিনিট সিজন করুন। আপনি চাইলে লাউশাককে স্যুপ,স্টার ফ্লাই,স্যালাদ ইত্যাদি রান্নায় ব্যবহার করা যায়।
সংগ্রহ ও উপভোগঃ লাউ শাক খুব তাড়াতাড়ি পরিপক্ক হয়ে যায়। তাই এটি রান্নার সময়েই খেতে হবে। লাউ শাককে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত একটি স্থানে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
লাউ শাক এর পুষ্টিগুণ
মানুষের কাছে জনপ্রিয় সবজি গুলোর মধ্যে লাউ অন্যতম। লাউ শাক খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর এবং লাউ শাকের উপকারিতা ও অনেক। লাউ নিরামিষ ভাজি ঝোল কিংবা সালাদ হিসেবে খাওয়া যায়।
প্রতি ১০০ গ্রাম লাউ এর রয়েছে কার্বোহাইড্রেট ২.৫ গ্রাম, প্রোটিন 0.2 গ্রাম, ফ্যাট 0.6 গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২০ মিগ্রা, ভিটামিন সি ৬ গ্রাম,ফসফরাস ১০ মিগ্রা,পটাশিয়াম ৮৭ মিগ্রা, নিকোটিনিক এসিড 0.2 মিগ্রা রয়েছে। এছাড়াও লাউ এ রয়েছে খনিজ লবণ, ভিটামিন বি ওয়ান, ভিটামিন বি টু, আয়রন ইত্যাদি আরো নানারকম পুষ্টি উপাদান।
এসব পুষ্টি উপাদান শুধু ওজন কমাতে সাহায্য করে না হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। এছাড়াও ত্বকের যত্নে লাউ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
লাউ শাক চাষ করতে কতদিন লাগে
বেশিরভাগ লাউ এর জন্য একটি দীর্ঘ ক্রমবর্ধমান সময় প্রয়োজন। সাধারণত ব্রিজ থেকে লাউ গাছ বড় হয়ে ফসল কাঁটা পর্যন্ত ৯০ দিন থেকে ১৮০ দিন সময় লাগে। লাউ পরিপক্ক হওয়ার সময় ফল গুলি শক্ত, চকচকে, শ্বাস বিকশিত হবে। ক্রমবর্ধমান জাতের জন্য আশা করা হয়, এগুলো মসৃণ বা ওয়াটই হতে পারে, উজ্জ্বল রং এর বা সাদা, কষা বা হালকা সবুজ হতে পারে।
লাউ শাক কখন বপন করতে হয়
লাউ বোপনের সময় হচ্ছে মধ্য শ্রাবন থেকে মধ্য কার্তিক এবং মধ্য ফাল্গুন থেকে মধ্য জ্যৈষ্ঠ। জাত ভেদে বীজের পরিমাণ হবে শতক প্রতি চার থেকে পাঁচ গ্রাম। পলিথিন ব্যাগে চারা তৈরি করলে রোপনের পর চারা দ্রুত বাড়ে।
৪*৫ ইঞ্চি আকারের ব্যাগে সমপরিমাণ বালি, মাটি ও পচা গোবরের মিশ্রণ ভর্তি করে ব্যাগের তলায় দুই থেকে তিনটি ছিদ্র করুন। তারপর সদ্য তোলা বীজ হলে রৌদ্রজ্জল, সহজে আলো বাতাস চলাচল করতে পারে এমন উর্বর জমি বীজতলার জন্য বেছে নিতে হবে। প্রতি মাদায় ৩-৪ টি বীজ ১-২ ইঞ্চি গভীরে পুতে ঢেকে দিতে হবে।
লাউ শাক চাষে কোন সার ভালো
প্রতি শতকের জন্য সারের পরিমাণ হবে গোবর বা কম্পোস্ট ৪০ কেজি, ইউরিয়া ২ কেজি, টিএসপি 1.6 কেজি, এম পি ১.২ কেজি,বোরণ ১০ গ্রাম। পিট তৈরির সময় গোবর, টিএসপি, বোরন, অর্ধেক পটাশ এবং পাঁচ ভাগের এক ভাগ ইউরিয়া সার মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। সার মেশানোর ১০ থেকে ১৫ দিন পর জমিতে বীজ বপন করতে হবে। অবশিষ্ট ইউরিয়া ও পটাশ সার সমান চার কিস্তিতে পুরো জীবন কালে উপরে প্রয়োগ করতে হবে।
লাউ কি টবে চাষ করা যায়
লাউ শাকের উপকারিতা যেমন অনেক বেশি তেমনি লাউ শাক চাষ করাও অনেক সহজ। বাড়ির ছাদে টবে বা ড্রামে সহজেই লাউ চাষ করা যায়। লাউ বীজ থেকে চারা গজানোর পর ১৬ থেকে ১৭ দিন বয়সের চারা টবে বা ড্রামে লাগানোর জন্য উপযুক্ত হয়। টবে বা ড্রামে লাউ চাষের ক্ষেত্রে প্রতিটি চারা কে পলিব্যাগ থেকে বের করে তবে বা ড্রামে রোপন করতে হবে।
সবচেয়ে ভালো হয় যদি প্রতিটি চারার জন্য আলাদা আলাদা টপ বা ড্রাম থাকে। লাউ চাষ করার জন্য টপে বা ড্রামে দোআঁশ মাটি দিতে হবে। টপ বা ড্রাম গুলো একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে স্থাপন করে নিবিড় পরিচর্যায় রাখতে হবে। মাচাই লাউ এর ফলন বেশি হয়। তাই অধিক ফলন পেতে হলে উত্তম রূপে মাচা তৈরি করে দিতে হবে।
লাউ শাকের অপকারিতা
লাউ শাকের উপকারিতা যেমন অনেক বেশি তেমনি এর কিছু অপকারিতা রয়েছে। লাউ এর অপকারিতা সম্পর্কে নিজে দেওয়া হলোঃ
১) লাউ এর রস তেতো হলে খাবেন না। কেননা লাউ এর রস যদি তেতো হয় তাহলে তা বিষাক্ত। আর লাউয়ের এই টি তো রস যদি খাওয়া হয় তাহলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া ডায়রিয়া, বমি এবং অস্থির ভাব হতে পারে। তাই লাউয়ের রস খাওয়ার আগে অবশ্যই পরীক্ষা করে নিতে হবে।
২) অনেক সময় লাউ খেলে এলার্জি হতে পারে। লাউ খাওয়ার পর যদি চুলকানি, জিভে কুটকুট বা গলায় চুলকানি হয় তাহলে বুঝতে হবে লাউ এ এলার্জি রয়েছে। তখন লাউ খাওয়া থেকে আপনাকে বিরত থাকতে হবে।
৩) অতিরিক্ত লাউ খাওয়ার ফলে রক্তচাপ হঠাৎ কমে যেতে পারে। যাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তাদের এই উচ্চ রক্তচাপ কমানোর জন্য লাউ খাওয়া ভালো। কিন্তু লাউয়ের রস অতিরিক্ত পান করলে হঠাৎ রক্তচাপ কমে যেতে পারে।
৪) অতিরিক্ত লাউ খাওয়ার ফলে রক্তে সুগারের পরিমাণ হঠাৎ কমে যেতে পারে। লাউ রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু অতিরিক্ত লাউ খেলে রক্তে শর্করার পরিমাণ হঠাৎ করে কমে যেতে পারে।
সতর্কতা
আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য লাউ শাকের উপকারিতা অনেক। তবে রান্নার সময় অনেক বেশিক্ষণ সিদ্ধ করে রান্না করা উচিত নয়। এছাড়াও লাউয়ে অতিরিক্ত মসলা ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকাই ভালো। লাউ একবার রান্না করে সাথে সাথে খেয়ে নিতে হবে। দীর্ঘদিন জাল করে খাওয়া থেকে বিরত থাকাই ভালো। কেননা বাসি তরকারি শরীরে উপকারে যে ক্ষতি বেশি করে।
লেখক এর মন্তব্য
আমাদের শরীরের জন্য লাউয়ের উপকারিতা অনেক তবে এর সামান্য কিছু অপকারিতাও রয়েছে। উক্ত আলোচনায় আমরা লাউয়ের উপকারিতা লাউয়ের চাষ পদ্ধতি এবং এর অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছি। লাউ চাষের মাধ্যমে আমরা আমাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথাও ভাবতে পারি।
এতক্ষণ ধরে আপনার মূল্যবান সময় দিয়ে আমাদের আর্টিকেলটি পড়ার জন্য আপনাকে জানাই অত্যন্ত ধন্যবাদ। এরকম তথ্যবহুল এবং আপনার কাছে ভালো লাগা আরো পোস্ট পেতে আমাদের ওয়েব সাইটটি বেশি বেশি ভিজিট করুন, কমেন্ট বক্সে আপনার মতামত দিন এবং শেয়ারের মাধ্যমে অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url