যাকাত দানের ফজিলত
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা সালাত আদায়ের পাশাপাশি যাকাত প্রদান করার কথা বলেছেন। যাকাত দানের ফজিলত অনেক। আজকে আমরা যাকাত দানের ফজিলত এবং যাকাত দানের গুরুত্ব ইসলামে কতটুকু সে সম্পর্কে ইনশাল্লাহ জানব।
যাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি। যাকাত শব্দের অর্থ পবিত্র করা। মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্ট লাভের জন্য সম্পদের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ কোরআনে বর্ণিত ৮ প্রকারের মধ্যে যেকোনো এক প্রকারের লোক বা প্রত্যেককে দান করে মালিক বানিয়ে দেওয়াই ভালো যাকাত।
ভূমিকা
যাকাত দানের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র হয় এবং সম্পদের বরকত হয়। যাকাত দেওয়ার মাধ্যমে গরিব অসহায় মানুষের হক আদায় হয়। ইসলাম যাদের যাকাত দেওয়ার সামর্থ্য রয়েছে তাদের জন্য যাকাত দেওয়াকে ফরজ করে দিয়েছেন। এবং মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের অনেক জায়গাতেই সালাত আদায়ের পর যাকাত প্রদানের কথা উল্লেখ করেছেন।
যাকাত দানের ফজিলত
দৈহিক ইবাদতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যেমন সালাত তেমনি আর থেকে ইবাদতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হল যাকাত। যাকাত দানের ফজিলত অনেক। যাকাত দানের ফজিলত গুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। নিচে যাকাত দানের ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
আরো পড়ুনঃশবে কদরের আলামত সমূহ এবং শবে কদরের তাৎপর্য বিস্তারিত জানুন
পরিপূর্ণ ঈমানের পরিচয়ঃ ঈমান পরিপূর্ণ করার অন্যতম একটি মাধ্যম হলো যাকাত প্রদান করা। আমাদের প্রিয়নবীর হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ' তোমার ঈমানের পরিপূর্ণতা হল তুমি সম্পদের যাকাত দাও'। যাকাত দানের মাধ্যমে সম্পদের পবিত্রতা অর্জন করা যায়।
আল্লাহর রহমত লাভঃ যারা যাকাত দান করেন তাদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন," এবং আমার রহমত সবকিছুকে পরিবেশ টন করে, তাই আমি শিগগিরই তোমাদেরকে আমার নিয়ামত সমূহ দেব, যারা ভয় করে এবং যাকাত দেয়"। পক্ষান্তরে যাকাত দেওয়া বন্ধ করা হলে আল্লাহ তা'আলা অসন্তুষ্টি হন এবং বৃষ্টি বন্ধ করে দেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,' যে জাতি তার মালের যাকাত দেওয়া বন্ধ করে দিবে, সে জাতির জন্য আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যদি অন্যান্য প্রাণীকুল না থাকতো, তাহলে কখনোই বৃষ্টি হতো না'।
সফলতার পথঃ যাকাত দান করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে ইহকালে এবং পরকালে সফল হওয়া যায়। পবিত্র কুরআনের যেসব সফলকাম ব্যাক্তিদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তারা প্রত্যেকেই যাকাত দানকারী ছিলেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন," অবশ্যই সফলতা অর্জন করেছে মুমিনরা, যারা নিজেদের নামাজে বিনয় এবং নম্র এবং যারা অনর্থক কথা বার্তা থেকে বিরত আর যারা যাকাত দান করে থাকে"।
আল্লাহর সাহায্যের জন্য উপযুক্তঃ অনেকেই মনে করেন যাকাত দিলে সম্পদ কমে যায়। কিন্তু না যাকাত দানের ফলে আল্লাহ তায়ালা তার সম্পর্কে আরো অনেক বেশি বৃদ্ধি করে দেন। যারা যাকাত দান করেন তাদেরকে মহান আল্লাহ তায়ালা সাহায্য করেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন," আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদের সাহায্য করবেন, যারা আল্লাহকে সাহায্য করে"।
মহান আল্লাহ তা'আলা আরো বলেন, "নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, শক্তিধর। তারা এমন লোক যাদের আমি পৃথিবীতে ক্ষমতা দান করলে, তারা নামাজ কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং সৎ কাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজে নিষেধ করে। নিশ্চয় প্রতিটি কর্মের পরিণাম আল্লাহর এক্তিয়ারভুক্ত"।
যাকাত দানের গুরুত্ব
ইসলাম শান্তি,সোহার্দ্য এবং ভাতৃত্বের ধর্ম। ইসলাম ধর্ম মানুষকে পরোপকারিতা, অন্যের বিপদে সাহায্য করার, দরিদ্র লোকদের প্রতি সহানুভূতি এবং মানুষের হক আদায় করা শিক্ষা দেয়। ইসলামে যাকাত দানের গুরুত্ব এবং যাকাত দানের ফজিলত অনেক। যাকাত দেওয়া ছাড়া দ্বীন পরিপূর্ণ হয় না। নিচে যাকাত দানের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
ইসলামে ঈমান আনার পর গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য ইবাদত হল সালাত ও যাকাত। পবিত্র কুরআনের অনেক জায়গাতে সালাতের পরে যাকাতের কথা বলা হয়েছে এবং এর ফলে আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য অশেষ রহমত, ছাওয়াব, মাগফিরাত এবং আত্মশুদ্ধির প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে।
যাদের জন্য যাকাত ফরজ কিন্তু তারা যাকাতকে অস্বীকার করলে তাদেরকে কাফের বলে গণ্য করা হয়েছে। যাকাত অস্বীকারকারীকে হত্যার কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় হিজরীতে যাকাত ফরজ বলে ঘোষণা করা হয়।
মহান আল্লাহ তায়ালা যাকাতের ফরজ বুঝানোর জন্য পবিত্র কুরআনুল কারীমে বলেছেন," আর তোমরা নামাজ কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং রূপকারীদের সাথে রুকু কর"। সূরা মায়ারিজের ২৪ ও ২৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তা'আলা বলেন," আর তাদের ধন-সম্পদে রয়েছে ভিক্ষুক এবং বঞ্চিতদের জন্য নির্দিষ্ট অধিকার"।
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত এবং হজ এই দুটি ইবাদত শুধুমাত্র যাদের ধন-সম্পদ রয়েছে তাদের জন্য। এটা শুধুমাত্র ধনী ব্যক্তিদের উপর ফরজ করা হয়েছে।
হাদিস শরীফে বর্ণিত আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- ' যদি তারা সেটাও মেনে নেয় তবে তাদেরকে অবগত করো যে, আল্লাহ তাআলা তাদের উপর তাদের সম্পদের মধ্য থেকে সাদকা( যাকাত) ফরজ করে দিয়েছেন। যেটা তাদের মধ্যে যারা ধনী তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে আর দরিদ্রদের মাঝে বন্টন করা হবে'।
পবিত্র কুরআনের এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে- তোমরা সালাত আদায় কর এবং যাকাত প্রদান কর। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য আগে প্রদান করবে তা আল্লাহর নিকটে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখছেন।
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, " তোমরা সালাত আদায় কর, যাকাত প্রদান কর এবং রাসূলের অনুসরণ কর যাতে তোমরা অনুগ্রহ ভাজন হতে পারো"। সূরা নিসার ১৬২ নাম্বার আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন," এবং যারা সালাত আদায় করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে আমি তাদেরকে মহাপুরুষ্কার দিব"।
এছাড়াও কুরআন মাজিদের আরো অনেক আয়াত থেকে পরিষ্কার ভাবে জানা যাচ্ছে যে, সালাত এবং যাকাতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব। তাই নিজেকে মুমিন হিসেবে পরিচয় দিতে গেলে অপরিহার্যভাবে সালাতের পাশাপাশি যাকাতের ব্যাপারেও গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
সামাজিকভাবে যাকাত দানের ফলে সমাজে ধনী এবং গরিবের বৈষম্য দূর হয়। আল্লাহ তাআলা নির্দেশমত যাদের যাকাত দেওয়ার সামর্থ্য রয়েছে তারা যদি যথাযথভাবে যাকাত দান করে তাহলে সমাজে কোন লোক অন্নহীন, বস্ত্রহীন এবং গৃহহীন থাকবে না।
সমাজের সম্পদশীল ব্যক্তিরা যাকাত প্রদানের মাধ্যমে দরিদ্র ব্যক্তিদের স্বাবলম্বী করে তুলতে পারে। এছাড়াও দরিদ্রদের জন্য সম্মিলিতভাবে এতিমখানা, চিকিৎসা কেন্দ্র এসবও করা যেতে পারে। যথাযথভাবে যাকাত আদায়ের ফলে এক সময় সমাজে আর কোন দরিদ্র অসহায় লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।
খলিফা হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ রাজাল্লাহু তা'আলা আনহু এর যুগে ইসলামি যাকাত ব্যবস্থা প্রচলন করা হয়েছিল, যার ফলে সেই যুগে যাকাত নেওয়ার মতো কোন লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। যাকাত ব্যবস্থা সমাজের কৃপণতা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা, হিংসা এবং আত্ম অহংকার প্রভৃতি থেকে পবিত্র করে।
যাকাত দানের ফলে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা পায়। ধনীদের সম্পদে গরীবদের হক রয়েছে। আর এই হক আদায় না করলে তার সম্পদ পবিত্র হবে না এবং সেই সম্পদ হালাল হবে না।
যাকাত না দেওয়ার পরিণতি
পবিত্র কুরআনুল কারীমে যাকাত দানকারীদের জন্য যেমন সুসংবাদ রয়েছে তেমনি যাকাত না দেওয়ার পরিণতি ও ভয়াবহ। যারা যাকাত আদায় করে না তাদের জন্য মহান আল্লাহ তা'আলা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন," যারা ধন-সম্পদ পুঞ্জিভূত করে রাখে এবং তা আল্লাহ পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও"।
পবিত্র কুরআনুল কারীমের আরো বর্ণিত আছে যে, এমন একদিন আসবে যেদিন এইসব সোনা এবং রোপ্য জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তাদের পূর্বদেশ, মুখমণ্ডল এবং পিঠে ঝলসানো হবে। আর বলা হবে এইসব তোমার ধন সম্পদ যা তুমি কুক্ষিগত করে রেখেছিলে কিন্তু যাকাত আদায় করনি। এই হল তোমার গুনাহের শাস্তি। এখন তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করো।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ' যারা যাকাত আদায় করে না কেয়ামতের দিন তাদের শেষ সম্পদ সাপ হয়ে তাদের দেহকে কঠিন ভাবে নিষ্পেষিত করবে এবং ছোবল দিবে আর বলতে থাকবে আমি হলাম তোমার সেই সঞ্চিত সম্পদ যাতে তুমি আসক্ত ছিলে'।
দুনিয়াতে আমরা ক্ষণস্থায়ী কিন্তু পরকালের আমাদের অনন্তকাল থাকতে হবে। আর এই সামান্য সম্পদের জন্য আমরা এই দীর্ঘ পরকালের জীবনটাকে কষ্টসাধ্য করে তোলাটা বোকামির কাজ। আর যারা যাকাত আদায় করেন না তাদের প্রতি আল্লাহর অসন্তুষ্টি নাযিল হয়। তার প্রত্যেক মুসলমানের উচিত যাদের সামর্থ্য রয়েছে তাদের যথাযথভাবে যাকাত আদায় করা।
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত
যাকাত দানের ফজিলত অনেক কিন্তু যাকাত সকলের জন্য নয়। যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত রয়েছে। যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তগুলো নিম্নরূপঃ
১) যাকাত আদায়ের জন্য অবশ্যই নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হবে। অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ এবং সাড়ে ৫২ তোলার রোপ্য কিংবা সমপরিমাণ নগদ অর্থ বা ব্যবসায়ের মাল থাকলে কেবল যাকাত ফরজ হয়।
২) যাকাত দানের জন্য অবশ্যই মুসলমান হতে হবে কেননা কাফেরদের কোন যাকাত নেই।
৩) যারা বালেগ শুধুমাত্র তাদের জন্যই যাকাত ফরজ। নাবালেগের এর উপর যাকাত ফরজ নয়।
৪) জ্ঞানী এবং বিবেকবান ব্যক্তিরা কেবল যাকাত আদায় করতে পারবেন। কারণ পাগলের ওপর যাকাত ফরজ নয়। পাগল ব্যক্তি যদি নিসাব পরিমান সম্পদের মালিকও হয় তারপরেও তার ওপর যাকাত ফরজ নয়।
৫) দাস দাসীর ওপর যাকাত ফরজ নয়। কেবলমাত্র মুক্ত বা স্বাধীন ব্যক্তির উপরে যাকাত ফরজ।
৬) যে মালের যাকাত দেওয়া হবে সেই মালের ওপর পূর্ণ মালিকানা থাকতে হবে।
৭) নিত্য দিনের প্রয়োজন মিটিয়ে যদি নিছাপ পরিমাণ সম্পদ থাকে তাহলেই যাকাত ফরজ হয়।
যাকাত কতবার দিতে হয়
বিবেকবান প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি যদি এক হিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তাহলে সে সম্পদের ২.৫% যাকাত দিতে হবে। এখন মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যাকাত কতবার দিতে হয়? এমন প্রশ্নের উত্তর হবে, বছরে একবার যাকাত প্রদান করতে হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ পূরণ হওয়ার পর এক চন্দ্র বছর বা এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথেই যাকাত প্রদান করতে হবে।
লেখক এর মন্তব্য
ইসলামের দৃষ্টিতে একজন মুসলমানের আলামত হলো সালাত আদায় করা এবং যাকাত প্রদান করা। তাই প্রত্যেক মুসলমানের ওপর বিশেষ করে যাদের জন্য যাকাত ফরজ তাদের যথাযথভাবে যাকাত প্রদান করা উচিত। এতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় এবং ইহকালীন ও পরকালীন শান্তির মাধ্যম ও বটে।
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত একটি তাই আমাদের উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যাকাত আদায় করা। প্রিয় পাঠক আমাদের আর্টিকেলটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে এবং এরকম তথ্যপূর্ণ আরো আর্টিকেল পেতে আমাদের সঙ্গে থাকুন, কমেন্ট বক্সে আপনার মতামত দিন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url