পটলের উপকারিতা ও অপকারিতাএবং
পটল মানুষের কাছে অতি পরিচিত একটি সবজি। পটলের উপকারিতা ও অপকারিতা দুটোই রয়েছে। কেউ কেউ পটলকে পছন্দ করে আবার কেউ কেউ এই সবজিকে অপছন্দ করে। আজকে আমরা পটলের উপকারিতা ও অপকারিতা এবং পটলের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
পটল দিয়ে আমরা বিভিন্ন ধরনের তরকারি খেয়ে থাকি। পটলের ভাজি, মাছ দিয়ে পটল ঝোল, পটলের ভর্তা এছাড়াও পটলের খোসার ভর্তা আমাদের অনেকের কাছে খুবই প্রিয়। পটল সাধারণত গ্রীষ্মকালে পাওয়া গেলেও এখন সারা বছরই পটল বাজারে দেখা যায়।
ভূমিকা
পটলের উপকারিতা ও অপকারিতা দুটোই রয়েছে। কিছু গবেষণায় পটলের মধ্যে যে ঔষধি গুন রয়েছে তা দেখা যায়। এছাড়াও পটলে রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ। পটলের উৎপাদন মাত্রা ও অনেক ভালো। চারা লাগানোর ৪৫ থেকে ৫০ দিনের মধ্যে ফসল পাওয়া যায়। তিন থেকে চারদিন পরপর পটল তোলা হয় এবং বাজারে এর অনেক চাহিদা রয়েছে।
আজকের এই আর্টিকেলটিতে আমরা পটলের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে জানব।
পটলের উপকারিতা ও অপকারিতা
পটল আমাদের দেশের মানুষের জন্য সহজলভ্য একটি সবজি। পটলের উপকারিতা ও অপকারিতা দুটোই রয়েছে। পটলের উপকারিতা সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলোঃ
ব্যথা নাশকঃ প্রাকৃতিক ব্যথা নাশক হিসেবে পটলের ভূমিকা অনেক রয়েছে। প্রাণীর ওপর এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, মাথাব্যথা ও পেট ব্যথা নিরসনে পটল অত্যন্ত কার্যকরী। এমনকি ব্যথা নাশক এসপিরিন এর তুলনায় ৪১% থেকে ৬৩% পর্যন্ত বেশি ব্যথা সারাতে পটল ভূমিকা পালন করে।
কৃমি নাশক হিসেবেঃ কৃমিনাশক গুণ রয়েছে পটলের মধ্যে। পটল এবং এর বীজ প্রাকৃতিক কৃমি বিনাশ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে পটলের বীজ কৃমি নাশক ঔষধের মত কার্যকরী।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতেঃ পটলের বীজ এবং পটলের পাতা ডায়াবেটিস নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যা বিভিন্ন ফার্মাকোলজিক্যাল গবেষণায় উঠে এসেছে। এছাড়াও ডায়াবেটিকস রোগীদের হাতে পায়ে অবশ অনুভব করা কমাতে পটলের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর উৎসঃ পটলে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা শরীরের ফ্রি রেডিকেল তৈরি করতে বাঁধা প্রধান করে এবং শরীরে বিভিন্ন স্থানে ক্ষত সারাতে ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, পটলের ফল, লতা ও কাণ্ডে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি এবং জ্বর প্রতিরোধ করার উপাদান গুলো রয়েছে।
এছাড়াও আর্সেনিকের প্রভাবে মানুষের শরীরে হওয়া বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করতে পটল কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
হজম ক্রিয়া স্বাভাবিক করতেঃ পটল কম ক্যালরিযুক্ত সবজি। কিন্তু ভিটামিন এবং ডায়েটরী ফাইবারের খুব ভালো উৎস এই সবজিটি। এটি পেটের বাওয়েল মুভমেন্ট স্বাভাবিক রাখে এবং হজম ক্রিয়া ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতেঃ সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই কোষ্ঠকাঠিন্যতায় ভোগেন। আর সময়মতো এর প্রতিকার না করা হলে এখান থেকে অনেক বড়সড় সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এই সমস্যা সমাধানের জন্য পটলের বীজ খুবই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
ওজন কমাতেঃ ওজন বৃদ্ধির বর্তমান বিশ্বের একটি মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন ধরনের জাঙ্ক ফুড এবং ওয়েস্টার্ন খাদ্য খাওয়ার জন্য মানুষের ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এই ওজন বৃদ্ধি বা মোটিয়ে যাওয়ার কারণে মানুষ বিভিন্ন রোগের সম্মুখীন হচ্ছে।
এর প্রতিকার হিসেবে আমরা অবশ্যই পটলকে বেছে নিতে পারে। কেননা পটল কম ক্যালরিযুক্ত একটি সবজি। তাই ওজন কমাতে কম ক্যালরিযুক্ত পটল খেতে পারেন।
রক্ত পরিষ্কারক হিসাবেঃ পটল ডিটক্সিফিকেশন এর মাধ্যমে আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। আয়ুর্বেদ চিকিৎসার শাস্ত্রমতে পটল রক্ত পরিষ্কার করতেও বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
জ্বর কমাতেঃ পটল রক্তের গ্লুকোজ কমাতে সাহায্য করে। এর সাথে সাথে রক্তের ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল কমাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পটলের বীজ রক্তের ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল কমায় এবং ভালো কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে জ্বর কমাতে সাহায্য করে।
এছাড়াও পটলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকায় সাধারণ সর্দি কাশি-জ্বর নিরাময় করতে পটলের ভূমিকা রয়েছে।
পটলের এন্টি এজিং গুনাগুনঃ পটলের ভিটামিন ই, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি এবং অধিক উচ্চ মাত্রার এন্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা ত্বকের কুঁচকে যাওয়া প্রতিরোধ করে। এর ফলে ত্বক টানটান থাকে এবং শরীরে বয়সের ছাপ ও দেখা যায় না।
জন্ডিস ও লিভার ফাংশন এর জন্য কার্যকরীঃ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্র মতে জন্ডিস ও লিভারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে পটলের ভূমিকা রয়েছে। এর পাতা, বীজ এবং ফল লিভারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।
অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল হিসাবেঃ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্র মতে আমাদের শরীরের ব্যাকটেরিয়াজনিত বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করতে পটলের পাতা, বীজ এবং ফল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রুচি বাড়াতেঃ আমাদের অনেক সময় খাবারের প্রতি অরুচি আসে। পটলের বিভিন্ন পদ আমাদের খাবারের প্রতি অরুচি দূর করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় এটি বহু কাল থেকে ব্যবহৃত হচ্ছে।
পটলের চাষ পদ্ধতি
পটলের উপকারিতা ও অপকারিতা এর পাশাপাশি পটলের চাষ পদ্ধতি আমাদের জন্য জেনে রাখা ভালো। পটল চাষ করার জন্য অনেক সূর্যালোক এবং তাপমাত্রা প্রয়োজন। আমাদের দেশের আবহাওয়া অনুযায়ী অক্টোবর থেকে নভেম্বর অথবা ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস পটল চাষের জন্য উপযোগী। নিচে পটলের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
জমি ও মাদা তৈরিঃ পটল চাষের জন্য বেলে দোআঁশ বা দু আস মাটি সমৃদ্ধ উঁচু জমি বাছাই করতে হবে যেখানে পানি নিষ্কাশনের সুবিধা রয়েছে। জমি ভালো করে চাষ করে এবং মই দিয়ে আগাছা মুক্ত করে মাটি সমান এবং ঝরঝরে করে নিতে হবে।
বেড পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য বেডের চওড়া ১. ০ থেকে ১. ৫ মিটার পর্যন্ত হতে হবে। দুই থেকে তিন হাত পর পর মাদাই চারা রোপন করতে হবে। দুই বেডের মাঝখানে ৭৫ সেন্টিমিটার নালা রাখতে হবে। মাদাই গাছের দূরত্ব ৭ থেকে ১০ সেন্টিমিটার হতে হবে এবং গভীরতা হতে হবে ৫০ সেন্টিমিটার।
চারা তৈরি এবং বপন পদ্ধতিঃ সাধারণত পটল কাণ্ড এবং টিউবারের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে থাকে। তবে পরিপক্ক কান্ড ব্যবহার করতে হবে শাখা কলমের ক্ষেত্রে। বাপনের আগে পটল চারা শিকড় গজিয়ে নিতে হবে। এছাড়া পলিব্যাগেও শাখা কলম লাগানো যায়।
পটল গাছের কান্ড মারা গেলেও এর শিকড় জীবিত থাকে। যার ফলে এই শিকর থেকে আবার নতুন গাছ জন্ম নেয়। বেডের মাঝামাঝি ১.০ থেকে ১.৫ মিটার বা দুই থেকে তিন হাত পর পর পটল চারা বপন করতে হবে।
চারা গাছ লাগানোর ৯০ থেকে ৯৫ দিনের মধ্যে ফলন পাওয়া যায়। পটল চাষের ক্ষেত্রে কয়েক দফায় শাখা কলম লাগিয়ে সারা বছর ফলন বা সম্ভব।
মাচা তৈরিঃ মাচা তৈরির মাধ্যমে পটল চাষ করলে পটলের ফলন ভালো হয়। পটল লতানি উদ্ভিদ হওয়ায় মাচা তৈরি করে দেওয়ার মাধ্যমে এর ফলন ভালো হয় এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়। মাটিতে খরকুটা বা কচুরিপানা বিছিয়ে দিয়ে চাষাবাদ করলে পটল মাটির সংস্পর্শে রোগাক্রান্ত হয় এবং এর ফুল ও ফল নষ্ট হয়ে যায় ও পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশি হয়।
সেচ ও পানি নিষ্কাশনঃ দীর্ঘ সময় ধরে পানির ঘাটতি হলে পটলের ফলন কমে যায়। তাই পটলের ভালো ফলনের জন্য নিয়মিত পানি সেচ দিতে হবে। আবার অন্যদিকে পটল গাছ সহ্য করতে পারে না। তাই অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে জলবদ্ধতা থাকলে তা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
সার প্রয়োগ ও রোগ বালাই দমনঃ পটল গাছের বৃদ্ধি এবং পটলের ফলন বৃদ্ধি করার জন্য গোবর বা জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি ইউরিয়া, টিএসপি এবং এমপি সার পরিমাণমতো হেক্টর প্রতি প্রতিমাসে প্রয়োগ করতে হবে। আবার পটলের গাছ এবং পটলকে পোকামাকড়, মাছি থেকে রক্ষা করার জন্য নিয়মিত কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।
পটলের অপকারিতা
পটলের উপকারিতা ও অপকারিতা রয়েছে। উপরে আমরা পটলের উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এখন আমরা পটলের অপকারিতা সম্পর্কে জানব। পটলের অপকারিতা সম্পর্কে কিছু তথ্য নিচে দেওয়া হলঃ
- অতিরিক্ত পরিমানে পটল খেলে পেটের সমস্যা যেমন গ্যাস্ট্রিক, পেট ফাঁপা ভাব ইত্যাদি হতে পারে। এছাড়া ও ডায়রিয়া এবং বদহজম ও হতে পারে।
- কিছু মানুষের পটলে এলার্জি রয়েছে। যাদের অ্যালার্জি রয়েছে তারা অতিরিক্ত পরিমাণে পটল খেলে চুলকানি, খোলা ভাব এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে।
- যাদের ঠান্ডার সমস্যা রয়েছে অতিরিক্ত পরিমাণে পটল খেলে তাদের সমস্যা হতে পারে। কেননা পটল ঠান্ডার প্রভাব ফেলে।
- পটবে রয়েছে অক্সালেট নামক উপাদান। যা শরীরে আয়রন এবং ক্যালসিয়াম শোষণে বাধা দিতে পারে। ফলে যাদের আয়নের ঘাটতির সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য অতিরিক্ত পটল না খাওয়াই ভালো।
- পটল রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক দিয়ে চাষ করা হয, যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তবে জৈব পদ্ধতিতে চাষকৃত পটল এবং বাজার থেকে কিনে পটল ভালোভাবে ধুয়ে খাওয়া আমাদের শরীরকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
পটলের পুষ্টিগুণ
পটলের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানিনা।পটল আমাদের দেহে শক্তি যোগাতে সাহায্য করে। নিচে পটলের পুষ্টিগুণ নিয়ে আলোচনা করা হলোঃ
প্রতি ১০০ গ্রাম পটলে খাদ্যশক্তি ৩১ কিলো ক্যালরি, ফাইবার ৩ গ্রাম, আমিষ ২.৪ গ্রাম, ভিটামিন এ ২৫৫ আইইউ, লোহা ১.৭ মিলিগ্রাম, শর্করা ৪.১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৩০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ২৯ মিলিগ্রাম, নিকোটিনিক এসিড ০.৫ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৪০ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ৮৩ মিলিগ্রাম এবং চর্বি ০.৬ গ্রাম রয়েছে।
পটল পাতার রস খেলে কি হয়
উপরে আমরা পটলের উপকারিতা ও অপকারিতা এবং পটলের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জেনেছি। এখন আমরা পটল পাতার রস খেলে কি হয় এ সম্পর্কে জানব-
আমাদের শরীরে কোন জায়গায় ক্ষত হলে পটল পাতার রস সেই ক্ষত সারাতে সাহায্য করে। এছাড়াও যারা চুল পড়ে টাক হয়ে যাচ্ছেন তাদের এই সমস্যা সমাধানেও পটল পাতার রস খুবই উপযোগী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পটলের ক্যালরি এবং ফ্যাট খুবই সামান্য পরিমাণে রয়েছে এবং পটল খেলে পেট ভর্তি থাকে। তাই যারা নিজেদের অতিরিক্ত ওজন কমাতে চাচ্ছেন তাদের জন্য পটল অত্যন্ত উপকারী।
লেখক এর মন্তব্য
এই আর্টিকেলটিতে আমরা পটলের উপকারিতা ও অপকারিতা, পটলের পুষ্টিগুণ এবং পটলের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে সুন্দরভাবে বিস্তারিত জেনেছি। পটল খাওয়ার মাধ্যমে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, হজম শক্তি উন্নত করা এবং আমাদের শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানো সম্ভব।তাই আমাদের খাদ্য তালিকায় স্বাস্থ্যকর খাদ্য হিসেবে পটল নিয়মিত খাওয়া উচিত।
আপনার মূল্যবান সময় দিয়ে আমাদের আর্টিকেলটি পড়ার জন্য আপনাকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। এরকম তথ্যবহুল ও আপনার কাছে ভালোলাগা আরো পোস্ট পেতে আমাদের ওয়েব সাইটটি বেশি বেশি ভিজিট করুন এবং শেয়ারের মাধ্যমে অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url