পাট চাষের গুরুত্ব এবং পাট চাষের পদ্ধতি
পাট বাংলাদেশের সোনালী আঁশ হিসেবে খ্যাত একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। আজকে আমরা পাট চাষের গুরুত্ব এবং পাট চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো ইনশাআল্লাহ। বাংলাদেশের আবহাওয়া পাট চাষের জন্য উপযোগী। যুগ যুগ ধরে এদেশে কৃষকদের সচ্ছলতার মূল উৎস ছিল পাট।
বিশ্বের যেসব দেশে পাট উৎপাদিত হয় সেসব দেশের যে বাংলাদেশের পাটের গুণগত মান অনেক ভালো এবং পাট উৎপাদনের বিবেচনায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সোনালী আঁশ এবং রুপালি কাঠি এই দুইটি মিলে একটি নতুন সম্ভাবনার নাম পাট। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় এক যুগ ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাটের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি।
ভূমিকা
গোটা বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতির অন্যতম অনুষঙ্গ হলো পাট। আমাদের দেশের প্রায় ২.৫ থেকে ৩.০ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাট চাষের সাথে জড়িত। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশের পাট ও পাট জাতীয় আঁশ গবেষণার প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। স্বল্প খরচে অধিক উৎপাদন সহ লাভজনক হওয়ায় পাট চাষের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি।
পাট চাষের গুরুত্ব
পাট পাতা, পাটের ছাল এবং পাটকাঠি এই সবগুলোই মানুষের ব্যবহারের উপযোগী। ব্যবসায়িক দিক থেকে পাট থেকে যেসব পণ্য উৎপাদিত হয় সেসব পণ্যের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে পাট দিয়ে তৈরি ব্যাগ। পাট চাষের গুরুত্ব অনেক রয়েছে। আমাদের স্কুল জীবনে আমাদের শিক্ষকগণ পাট বা সোনালী আঁশের ওপর প্রবন্ধ লিখতে বলবেন।
আরো পড়ুনঃমাছ চাষের প্রয়োজনীয়তা ও মৎস্য চাষ বিষয়ক বিজ্ঞান
অর্থনৈতিক ভাবে পাটের গুরুত্বের পাশাপাশি শিক্ষামূলক গুরুত্ব ও পাটের ছিল যার কারণে পাটকে 'সোনালী আঁশ' বলে আখ্যায়িত দেওয়া হয়। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো এই যে, পার্ট বা পাট জাত দ্রব্যের পণ্য উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়ছে না। সারা বিশ্বে বাজারজাতকরণের প্লাস্টিকের ব্যবহারের কারণে পাট জাত পণ্যের অবস্থানকে স্নান করে দিয়েছে।
যার ফলে এই মূল্যবান পণ্যের রপ্তানি আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। পাটের ব্যাগের বৈশ্বিক বাজারের আকার ২০২২ সালের ২.২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০২৩ সালে ১৪.৩% বার্ষিক চক্রবৃদ্ধির হারে ২.৫৯ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। পাট জাত ব্যাগের বাজারের আকার ২০১৭ সালে ১০.৪% হারে বেড়ে ৩ পয়েন্ট ৮৪ বিলিয়ন ডলারের পৌঁছাবে বলে আশা করা যায়।
আমাদের দেশে সাদা এবং তোষা উভয় রকমের পাট জন্মে। পাট এবং পাট জাত পণ্যের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশের পাট থেকে ২৮৫টি পণ্য উৎপাদন করা হয় এবং সেগুলো বিশ্ববাজারে রপ্তানি করা হয়।
পাটের প্রধান প্রধান পণ্যের মধ্যে রয়েছে কাঁচা পাট, ব্যাগ, দড়ি, ফুলের ঝুড়ি, ওয়ালেট আরো অনেক রকমের পণ্য উৎপাদিত হয়। বর্তমানে পাট থেকে শাড়ি, শার্ট, পাঞ্জাবি, জুতা এবং আরো অনেক পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। পাট থেকে উৎপাদিত পণ্য ব্যবহারের ফলে প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়।
এছাড়াও পাট গাছের চারা অত্যন্ত কমল এবং সবজি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। স্বাদ এবং ঔষধি গুণের কারণে এই সবজিটি মানুষের খুবই প্রিয়। পাট চাষের সময়ে এক হেক্টর জমির পাট ১১ টন পর্যন্ত অক্সিজেন নির্গত করে বায়ুকে বিশুদ্ধ করে এবং এটি মাটির গুনাগত মান উন্নত করে।
পাট চাষের পদ্ধতি
ফাল্গুনের শেষ থেকে আষাঢ়ের শেষ পর্যন্ত পাট উৎপাদনের মৌসুম। দেশি পাট, তোষা পাট, কেনাফ ও মেস্তা পাট এই চার ধরনের পাট আজ ফসলের জন্য ভাল। নিচে পাট চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
দোআঁশ মাটি সমৃদ্ধ উঁচু এবং মধ্যম উঁচু জমি যেখানে বৃষ্টির পানি জমে থাকে না এমন জায়গা পাট চাষের জন্য বেশি উপযোগী। বৃষ্টিপাত হওয়ার পরপরই পাঁচ থেকে সাতটি চাষ দিয়ে জমি পাট চাষের জন্য তৈরি করে নিতে হবে। জমির ঢেলাগুলো গুঁড়ো করে নিতে হবে এবং জমিতে আগাছা মুক্ত করে নিতে হবে।
জমি ভালোভাবে প্রস্তুত করার পর বীজ বপণের দুই থেকে তিন সপ্তাহ আগে ৩.৫ টন গোবর সার মিশিয়ে দিতে হবে। বীজ বোপনের দিন ১৫ কেজি ইউরিয়া, ১৭ কেজি টিএসপি এবং ২২ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপনের ছয় থেকে সাত সপ্তাহ পরে ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার এবং চারা গাছ পাতলা করে দিতে হবে।
এরপর ১০০ কেজি ইউরিয়া সার জমিতে পুনরায় ছিটিয়ে দিতে হবে। পাঠ বীজ সময়মতো বপন করা উচিত। সাধারণত কৃষকরা ছিটিয়ে পাট বীজ বপন করে। তবে লাইন করে বপন করলে পাটের ফলন অনেক ভালো হয়।
বীজ বপনের পনেরো থেকে 21 দিনের মধ্যে প্রথম নিরাণী এবং ৩৫ থেকে ৪২ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় নিরামি দিয়ে আগাছা দমন করতে হবে এবং সেই সাথে চারা গাছ পাতলা করে দিতে হবে। এবং চারা গাছকে বিভিন্ন পোকা মাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ অনুযায়ী কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
পাটের ব্যবহার
পাটের ব্যবহারের কারণে পাট চাষের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। আমরা বিভিন্নভাবে পাটের ব্যবহার করতে পারি। পাটের আসের প্রাথমিক ব্যবহার হল বিস্তৃত পরিসরে কৃষি ও শিল্পজাত পণ্যের প্যাকেজিংয়ের জন্য ব্যাগ, বস্তা, প্যাক এবং মোড়ক তৈরি করা।
ভারী, শক্ত কাপড় তৈরি করতে যেখানে স্ট্রেচিং সুতার প্রয়োজন সেখানে খুব সহজেই এবং কম খরচে পাট ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও পাট থেকে বারলাম তৈরি করা হয়।
পাটের সবচেয়ে ক্ষতিকর পোকার নাম কি
পাট চাষের গুরুত্ব অনেক। কৃষক স্বল্প খরচে অতি সহজেই পাট চাষ করে লাভবান হতে পারে। আমরা পাট চাষের গুরুত্ব এবং এর উৎপাদন পদ্ধতি জানলেও আমাদের মনে প্রশ্ন থেকে যায় যে, পাটের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রকার নাম কি? পাটের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রকার নাম হল ঘোড়া পোকা।
জৈষ্ঠ্য মাস থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত এই পোকা পাট খেতে আক্রমণ বেশি করে। তোষা পাটে দেশি পাটের তুলনায় এই প্রকার আক্রমণ বেশি দেখা যায়। ডিম ফুটে কিরা বের হওয়ার সাথে সাথেই এরা পাট গাছের কচি ডগা এবং পাতায় আক্রমণ করে থাকে। প্রথমদিকে এরা পাতা ছিদ্র করে খেলেও বড় হওয়ার সাথে সাথে এরা পুরো পাতায় খেয়ে ফেলে।
এছাড়াও কোন কোন সময় এরা পাটের কচি ডগা খেয়ে ফেলে। পাটের মৌসুমে এরা দুই থেকে তিনবার বংশবিস্তার করে থাকে। পাটের কচি ডগা খেয়ে ফেলার ফলে পাটের শাখা প্রশাখা বের হয়। এতে পাটের ফলন এবং আঁশের গুণগত মান কমে যায়।
পাট খেতে ঘোড়া পোকার আক্রমণ বেশি হলে বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে হেয়াজিনন, ডায়াজিনন বা সাইফারমে ট্রেন জাতীয় কীটনাশক পরিমাণ মতো পানির সাথে মিশ দশ দিন পর পর দুই থেকে তিন বার করে স্প্রে করে দিতে হবে।
জুট ফাইবার কোথায় পাওয়া যায়
জুট ফাইবার কোথায় পাওয়া যায়? এমন প্রশ্নের উত্তর হিসেবে আমরা বলতে পারি পাটের ফাইবার হল সবুজ কম্পজিটের জন্য একটি জনপ্রিয় শক্তি বৃদ্ধি। এটি টিলিয়াসি পরিবারের অন্তর্গত এবং ফাইবার কর্কোরাস উদ্ভিদ থেকে পাওয়া যায়। চিন, ভারত এবং বাংলাদেশসহ এশিয়া মহাদেশের অন্যান্য অনেক বেশি পাট জন্মে।
প্রাকৃতিক ফাইবারের মধ্যে জুট ফাইবার হল সেলুলোজিক ফাইবার। জুট ফাইবারে লীগনো সলুলোজ থাকে যার কারণে জুট ফাইবার শক্ত এবং খসখসে হয়। জুট ফাইবার অর্থাৎ পাট আশ শক্তও খসখসে থাকার কারণে সুতা তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়।
সুতা তৈরি করার জন্য পাঁক দেওয়ার সাথে সাথে এই আঁশ ভেঙে যেতে পারে। আর এই ভঙ্গুরতা দূর করার জন্য সুতা তৈরির পূর্বে ইমালশন প্রয়োগ করতে হবে।
লেখকের মন্তব্য
পাট চাষের গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। তবে বর্তমানে পার জাত পণ্যের ব্যবহার কমে যাওয়ার কারণে পাটের রপ্তানির হার কমে গেছে। আমাদের পরিবেশকে সুস্থ এবং সুন্দর রাখার জন্য আধুনিক প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করে পাটজাত পণ্য ব্যবহার করা উচিত। এতে পরিবেশ যেমন সুস্থ থাকবে তেমনি কৃষক পাট উৎপাদন করে লাভবান হতে পারবে।
প্রিয় পাঠক এতক্ষণ ধরে আপনার মূল্যবান সময় দিয়ে আমাদের আর্টিকেলটি পড়ার জন্য আপনাকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ। এরকম তথ্যপূর্ণ এবং আপনার কাছে ভালোলাগা আরো পোস্ট পেতে আমাদের ওয়েব সাইটটি বেশি বেশি ভিজিট করুন, কমেন্ট বক্সে আপনার মতামত দিন এবং শেয়ারের মাধ্যমে অন্যদের পড়ার সুযোগ করে দিন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url